বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র - এম. এ. ওয়াজেদ আলী

0
বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র এম. এ. ওয়াজেদ আলী ভূমিকা ১ স্বাধীন বাংলাদেশ তথা এ ভূখণ্ডের স্বাধীন বাঙ্গালী জাতিকে তার সুদীর্ঘকালের স্বপ্ন, আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে ও মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠায় যে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপুল ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে তার কিছু বিবরণ এই গ্রন্থটিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। 
সেসব আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি অনেক সাফল্য অর্জন করলেও তার স্বপ্ন ও আশা আকাক্ষার অনেক কিছু অপূর্ণ রয়ে গেছে। জাতির সেসব ব্যর্থতা ও হতাশার কারণ কি এবং তার জন্য কে বা কারা দায়ী, জাতির রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া অনেক উল্লেখযােগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই গ্রন্থে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সে সম্পর্কে কিছুটা আলােকপাতের প্রয়াস করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড সংগঠনে এবং জনমত গড়ায় যাদের সার্থক ভূমিকা পালন ও আবদান রাখার অবকাশ রয়েছে, সেসব নেতা-কর্মী জাতির স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটুকু দায়িত্ববােধের পরিচয় দিয়েছেন সে সম্পর্কেও এই গ্রন্থে কিছুটা তার আলােকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে। ২ ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশকে বিভক্ত করে পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হলে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ তার নিজেদের আদর্শ ও বিশ্বাসের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েও পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন এই আশায় যে, নতুন রাষ্ট্র কাঠামাের মধ্যে থেকেও তারা অধিকতর স্বাধীনভাবে নিজেদের ঐতিহ্য, শিল্প সংস্কৃতি-ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে, প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এবং সর্বোপরি আদর্শ, বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের সুযােগ পাবেন। কিন্তু, পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী ও পশ্চিম পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে আশ্রয় গ্রহণকারী উর্দুভাষী, বিশেষ করে পাঞ্জাবী সামরিক-বেসামরিক শাসকগােষ্ঠী এ ভূখণ্ডের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করে এবং এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে প্রশাসনিক ও সামরিক আধিপত্য বিস্তার এবং অন্যান্য শােষণ-বঞ্চনার মাধ্যমে এ ভূখণ্ডকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কলােনীতে পরিণত করার চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। এ ভূখণ্ডেরই অনেক নেতা-কর্মী তাদের নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর সে চক্রান্তে সহায়তাও করেছিল। ৩ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর সেসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে এ ভূখণ্ডের মানুষ বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্নভাবে অনেক প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেছেন এবং প্রাণও বিসর্জন দিয়েছেন। অবশেষে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ ভূখণ্ডের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত বাঙালীর মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬-দফার ভিত্তিতে এ ভূখণ্ডের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হন। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী ও কতিপয় চক্রান্তকারী রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সে দাবি মেনে নিলে তিনি বাঙ্গালী জাতিকে এ ভূখণ্ডের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার জন্য উজ্জীবিত ও সুসংগঠিত করেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বেসামরিক শাসকগােষ্ঠী এবং কতিপয় রাজনৈতিক কুচক্রী মহল এ ভূখণ্ডের মানুষকে চিরতরে দাবিয়ে রাখতে গণহত্যা শুরু করলে এদেশের কতিপয় পশ্চিম পাকিস্তানী দালাল ছাড়া ধর্ম, বর্ণ, গােত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র বাঙ্গালী জনগােষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহবানে পশ্চিম পাকিস্তানের নিগড় থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রাম ও যুদ্ধে লিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশিত পথে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে এবং লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে বাঙ্গালী জাতি তার স্বাধীনতা ও স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করে। তারপর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানী নেই একই সামরিক-বেসামরিক শাসকগােষ্ঠী ও কতিপয় রাজনৈতিক কুচক্রী মহল তাকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নতুন করে ষড়যন্ত্র আঁটে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে পাকিস্তানের সে ষড়যন্ত্রের সহায়তা ও অংশ গ্রহণ করে এদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মুষ্টিমেয় পাকিস্তানী এজেন্ট, কতিপয় বিভ্রান্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সেই একই স্বাধীনতাবিরােধী রাজনৈতিক কুচক্রী মহল। সেসব চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সেই একই শাসকগােষ্ঠী ও রাজনৈতিক কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে সপরিবারে হত্যা করে। বাংলাদেশে সংঘটিত সেসব ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং সেসব ঘটানাের মূল উদ্দেশ্যও এই গ্রন্থে আলােচনা করা হয়েছে। ৪ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বাংলাদেশে জারি করা হয় সামরিক শাসন। ঐ সুযােগে বাংলাদেশের কতিপয় মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাষী সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চক্রান্তে লিপ্ত হয়। সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সেনা বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল (পরবর্তীকালে লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। দেশে গণতন্ত্র রক্ষার নামে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে প্রথমে তার ওপর জনগণের আস্থা আছে কি-না সে সম্পর্কে হঁ্যা বা না-এর প্রহসনমূলক গণভােটের ব্যবস্থা করেন এবং তারপর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে বিপুল রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের অপচয়ের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিকে রাজনীতিকদের জন্য কঠিন করে তােলেন। সামরিক আইনের সুযােগে ও ক্ষমতা বলে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধূলিসাৎ করে দেশে সেই পাকিস্তানী মতাদর্শ ও ধ্যান-ধারণার পুনঃপ্রবর্তন করেন।

আমার বই.ডট কমের সৌজন্যে


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)